অর্থনীতি নিয়ে সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে
বাংলাদেশে অর্থনীতি সাংবাদিকতার পরিসর দিন দিন-ই বাড়ছে। পত্রিকা, অনলাইন কিংবা টেলিভিশনে নিয়মিতভাবে পৃথক বা আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সংবাদ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকি বিজ শো, টক শো পরিচালনা করে আসছে গণমাধ্যমগুলো। প্রতিটি মিডিয়া হাউসে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বিকাশমান অর্থনীতির ধারা আমলে নিয়ে আলাদা বিট-ই পরিচালনা করে আসছে গেল এক দশকের বেশি সময় ধরে।
সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত সংবাদকর্মী, রিপোর্টার নিয়োগ দিয়ে আসছে। তবে অর্থনীতি সাংবাদিকতায় পুরুষের যতটা সরব উপস্থিতি দেখা যায় সে তুলনায় নারী সাংবাদিক একবারে হাতেগোনা। অর্থনীতি সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের তথ্য দেখলেও বোঝা যায় নিয়মিত অর্থনীতি সংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহ করছেন কিংবা সাংবাদিকতা করছেন এমন নারী আছেন মাত্র ২৩ জন। মাঠ কিংবা ডেস্কে অর্থনীতি সাংবাদিকতায় নিয়োজিত পত্রিকায় নারীদের সংখ্যাটা কম বেশি থাকলেও টেলিভিশনে একবারে হাতেগোনা। এদের-ই একজন কাবেরী মৈত্রেয়। শুরুটা পত্রিকায় হলেও গেল এক দশক ধরে নিয়মিত মাঠে প্রান্তরে ছুটছেন।
কাবেরী মৈত্রেয়ের জন্ম নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন, মা গৃহিণী। তিন ভাই বোনের মধ্যে মেঝ তিনি। পড়াশোনা শেষ করেছেন অর্থনীতি বিষয়ে। পড়াশোনা অবস্থায় বিয়ে এরপরপরই সন্তান। স্নাতকোত্তর শেষে কাবেরীর পেশাগত জীবনটা শুরু হয়েছিল বেসরকারি এক ব্যাংক দিয়ে। সেখানে বছর দেড়েক কর্মরত থাকার পর, করপোরেট প্রতিষ্ঠানে আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে হুট করে পত্রিকায় যোগ দেন। কিছুদিন সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন দৈনিক আমাদের সময়ে। এরপরপরই আবারও আরেক পত্রিকায় যোগ দেন, সেখানে মূলত মাঠের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। শুরুতে ব্যাংকিং, আর্থিক খাত নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে অর্থ, পরিকল্পনা, কৃষি, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, গবেষণা সংস্থাগুলো নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
২০১৪ সাল থেকে কর্মরত আছেন একাত্তর টেলিভিশনে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে। এরই মধ্যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন রিপোর্টারদের দুই শীর্ষ সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-ডিআরইউ, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম ইআরএফের। পেয়েছেন এমআরডিআইসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য ফেলোশিপ, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন পদকও পেয়েছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানের হয়ে দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পরিম-লে একাধিক প্রোগ্রাম কাভার করেছেন, এমনকি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে দেশের ভেতরেও নিয়মিত অর্থনীতিবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কাভার করছেন গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। আজকের আয়োজন তাকে নিয়ে।
সাক্ষাৎকার-
আপনি তো গেল এক দশক ধরে কাজ করছেন অর্থনীতি সাংবাদিকতা নিয়ে, কি মনে করে এই বিশেষায়িত খাতে?
উত্তর : এ প্রশ্ন আমার অনেক সহকর্মী করেন। আমি মজা করে উত্তর দেই এভাবে, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক থেকে প্রেমে পড়া এখনো ছাড়তে পারিনি। এর মানে হলো এই যে, অংকে দুর্বল হলেও অর্থনীতিতে বেশ মনোযোগ ছিল আমার মাধ্যমিক থেকে। গ্রাফ, বিশ্লেষণ, তথ্যগুলো আকর্ষণ করত খুব। এ কারণে দুই পরীক্ষায় এ বিষয়ে এ-প্লাস পেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়েও এ সাবজেক্টে পড়ার ইচ্ছে ছিল যদিও পরিবার চাইত ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। কিন্তু চান্স পাইনি। ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় এগিয়ে থাকার কারণে সহজে ভর্তির সুযোগ পায় পরে শেষ করা। যখন সাংবাদিকতায় আসি পত্রিকায় তখন আমার সাবেক চিফ রিপোর্টার জানালেন, যেহেতু অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা তাই শুরুটা ব্যাংক ও আর্থিক খাত দিয়েই করতে হবে। আমারও স্বস্তি লেগেছিল এই ভেবে যে ব্যাংকের কিছুটা জানতাম। এই তো এভাবে আসা।
গেল এক দশকে নারী সংবাদকর্মীর সংখ্যাটা কেমন দেখছেন এ বিটে?
উত্তর : সত্যি বলতে কি, যবে থেকে অর্থনীতি সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি আমার মাঠে কাজ করছেন এমন নারী সহকর্মী কমই পেয়েছি। এ সংখ্যাটা যতটা না বেড়েছে তার তুলনায় কমেছে বেশি। নারীদের মাঠ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা, সোর্স রক্ষা করা এমনকি তা লালন পালন করা সহজ অর্থে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা চ্যালেঞ্জ। একজন পুরুষ সহকর্মী কোনো একটি বিশেষ সংবাদ বা অনুসন্ধানের নিমিত্তে সোর্স রক্ষা করতে চাইলে যে পথগুলো অবলম্বন করেন নারীদের ক্ষেত্রে সেগুলো ততটা সহজভাবে সমাজ নেয় না। এই যেমন অফিস শেষ করে সন্ধ্যার পর একজন সোর্সের সঙ্গে দেখা বা কথা বলতে একজন পুরুষ সহকর্মী কিন্তু বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না যেখানে নারীটি দুবার ভাববেন। এছাড়া, অফিসের কর্মপরিবেশ তো আছেই। বাসায় ফিরে সংসারের চাপে পড়াশোনা করতে পারেন না অনেক নারী সহকর্মী, সন্তান পরিবারের দেখভাল করতে গিয়ে ইভেন্টগুলো মিস করেন সোজা কথায় মাঠে কাজ করার আগ্রহটি হারিয়ে ফেলেন। যারাও বা কাজ করতে চান তাদের বেশিরভাগ আগ্রহ ডেস্কে বা সংবাদ উপস্থাপনে।
আপনি বলছিলেন, পরিবার ও সমাজ প্রতিবন্ধকতার নিয়ামক সেটির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোও কি!
সবার আগে বুঝতে হবে আমি মানে নারী সাংবাদিক হিসেবে আমার অবস্থান কতটা পাকাপোক্ত আমার কাছে। পরিবার হলো মূল। যদি সেখানে সহায়তা পাওয়া যায় সোজা কথায় বলি, এ পেশার ধরনটা গতানুগতিক নয়, এখানে সংসার আর পেশার মধ্যে ব্যবধান বলে কিছু নেই। রাত-বিরাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, ডে অফের দিন অফিস করতে হতে পারে, বাসায় ফিরতে রাত কিংবা ভোরেও কর্মস্থলে যাওয়া কিংবা বাড়ির বাইরেও থাকতে হতে পারে সবগুলো বোঝাপড়ার মাধ্যমে করলে পেশায় মনোযোগ দেওয়া সম্ভব, আকর্ষণও বাড়ে। বেশিরভাগ সময় পরিবার কিন্তু সহযোগিতামূলক আচরণ করে না। প্রতিষ্ঠানও কিন্তু নানা বিবেচনায় নারী সহকর্মীটিকে গুরুত্ব দেয় না, তার দ্বারা কাজটি শেষ হবে কিনা সে সন্দেহ থেকে। কর্মঘণ্টা, কর্মস্থল সবমিলিয়ে সবক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতি সাংবাদিকতার সম্ভাবনাটাও যদি তুলে ধরতেন!