এবার দু’দলের কর্মসূচি ‘পাল্টাপাল্টি’ স্থগিত


একই দিন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ডেকে রাজপথে উত্তেজনা ছড়ানো আওয়ামী লীগ-বিএনপি এবার নিজ নিজ কর্মসূচি পাল্টাপাল্টি স্থগিত করে নতুন আলোচনার খাতা খুলেছে। রাজনীতির মাঠের প্রধান দুই দলের কর্মসূচি স্থগিতের কারণও অভিন্ন। দু’দলই বলছে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনায় সহানুভূতি দেখাতে ‘কর্মসূচি স্থগিত’। ক্ষমতাসীন ও সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি পাল্টাপাল্টি স্থগিতের ঘটনায় অনেকেই আপাত স্বস্তি খুঁজছেন।
তবে রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা কর্মসূচি পাল্টাপাল্টি স্থগিতের বিষয়টিকে ‘সাময়িক’ বলে মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্প ইস্যু শেষ হতে না হতেই ফের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নেমে যাবে দুই দলই। যা জনমনে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াবে, সহিংসতা-নৈরাজ্যের আশঙ্কাকেও বাড়িয়ে তুলবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই এমন পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত বলেও মনে করছেন তাঁরা।
বিএনপির চলমান আন্দোলনের সর্বশেষ কর্মসূচি ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে পদযাত্রা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আয়োজনে এই পদযাত্রা দুপুর ২টায় আরামবাগের ব্রাদার্স ক্লাবের সামনে থেকে শুরু হয়ে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। তবে বুধবার মধ্যরাতে বিএনপি এই কর্মসূচি স্থগিত করে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় শোক, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করতে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে বলে দলের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
অন্যদিকে, বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের তরফ থেকে একই দিন রাজধানীতে আলাদা দুটি শান্তি সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। বিএনপির সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের আয়োজনে গতকাল দুপুর আড়াইটায় রাজধানীর পল্লবীর ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে লাল মাঠে এবং যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে একই দিন একই সময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি সমাবেশ দুটি হওয়ার কথা ছিল। তবে বিএনপির কর্মসূচি স্থগিতের আধাদিন পর গতকাল সকালে সংগঠন দুটি আলাদা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শান্তি সমাবেশ স্থগিত করে। কর্মসূচি স্থগিতের কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগ তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের ঘটনায় বৃহস্পতিবার দেশে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের কথা জানায়।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে কয়েক মাস রাজনীতিতে চড়ে আছে উত্তাপ। উত্তেজনার মধ্যে ব্যতিক্রম উদাহরণও রয়েছে। যেমন- গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে সরকার পতন এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১০ দফা ঘোষণার পর ২৪ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি দেওয়া হয়। একই দিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের তারিখ পড়ায় ওইদিন কর্মসূচি না রাখতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানান ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। পরে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক এবং জোট ও সমমনা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকার কর্মসূচিতে বদল আনা হয়। সারাদেশে ঘোষিত ওইদিনের কর্মসূচি পালন করা হলেও ঢাকার যুগপৎ কর্মসূচি ২৪ ডিসেম্বরের বদলে ৩০ ডিসেম্বর পালন করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
তবে আওয়ামী লীগের আহ্বানে বিএনপি নিজেদের কর্মসূচি পাল্টালেও এতদিন দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি একের পর এক চলছিল। বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো যেদিন কর্মসূচি দিচ্ছিল, একই দিনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে পাল্টা কর্মসূচি আসছিল। বিএনপি বারবার তাদের ঘোষিত কর্মসূচির দিন পাল্টা কর্মসূচি থেকে সরে আসার আহ্বান জানালেও ক্ষমতাসীন দল তাতে সাড়া দেয়নি। আওয়ামী লীগ অবশ্য বরাবরই বলে আসছে, কোনো পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নয়, বিএনপি ও তাদের জোটের সম্ভাব্য সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নৈরাজ্য ঠেকানোর লক্ষ্যেই রাজপথে সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে তারা।
এ দিকে গতকালের কর্মসূচি স্থগিত হয়ে গেলেও আগামীকাল শনিবার সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি বহাল রেখেছে বিএনপি। একই দিন আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের পদযাত্রার পাল্টা কর্মসূচিও থাকছে। এ ছাড়া রোববার রাজধানীতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচির দিনও পাল্টা কর্মসূচি ডাকার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। আজ শুক্রবার আওয়ামী লীগের সেই কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।
তবে দুই দলের নেতারাই অভিন্ন সুরে বলেছেন, নিজ নিজ দলের কর্মসূচি সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। তবে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটে মানবিক কারণে কর্মসূচি থেকে সরে এসেছেন তাঁরা। এর বাইরে কর্মসূচি স্থগিতের আর কোনো কারণ নেই বলেও জানিয়েছেন দুই দলের নেতারা।
দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, তুরস্ক ও সিরিয়ার মানুষের প্রতি সহানভূতি জানিয়ে দু’দল নিজেদের কর্মসূচি স্থগিত করেছে। এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। তবে এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। প্রতিদিনই তো আর এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। তাই আগামী দিনগুলোতেও রাজনৈতিক দলগুলোকে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির ফল খুব একটা ভালো হয় না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘আমার কাছে এটা বালখিল্য কিংবা বাচ্চাদের মতো আচরণ বলে মনে হয়েছে। এটা অসভ্যতা, এটা কোনো রাজনৈতিক আচরণ হতে পারে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই- যতক্ষণ পর্যন্ত বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতা না ঘটবে। আর এই সমঝোতা না ঘটলে বহিঃশত্রু এটার সুযোগ নেবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম বলেন, ‘আগে থেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত শান্তি সমাবেশসহ রাজপথের কর্মসূচি চলবে। কাজেই তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেশে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের কারণে বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও আগামী দিনের কর্মসূচিগুলো অব্যাহত থাকবে। কেননা এই কর্মসূচিগুলো তাঁরা কোনো দলের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে দিচ্ছেন না। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং জনগণের স্বার্থেই কর্মসূচিগুলো পালন করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনায় বিএনপি শোকাহত। পুরো বিশ্ব এই ঘটনায় মর্মাহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও একদিনের শোক পালন করছে। এ অবস্থায় তাঁদের দলীয় কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। তবে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলো অব্যাহত থাকবে।’ এ ক্ষেত্রে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে না যেতে আওয়ামী লীগের প্রতি আবারও আহ্বান জানান বিএনপির নীতিনির্ধারক এই নেতা।