ট্রমায় থেকেও দুই সন্তানকে খুঁজছেন সেই নারী

অথর
কুষ্টিয়া অনুসন্ধান নিউজ ডেক্স :   বাংলাদেশ
প্রকাশিত :১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ | নিউজটি পড়া হয়েছে : 109 বার
ট্রমায় থেকেও দুই সন্তানকে খুঁজছেন সেই নারী

গর্ভধারিণীকেও এখন চিনছেন না। মাকে দেখলেও কুঁকড়ে যাচ্ছেন ভয়ে। বকছেন আবোল-তাবোল। শুনতে চাচ্ছেন না কারও কথা। কাউকে না জানিয়ে যশোরের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রথম পক্ষের স্বামী ও সন্তানদের খুঁজতে এ তরুণী এসেছিলেন রাজধানীতে, ইট-পাথরের নগরে। এরপর সর্বনাশ। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়ে এখন ওই তরুণী কাঁদছেন অঝোরে। গত বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলায় ঘটা এমন নির্মমতার স্মৃতি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় তিনি ফিরেছেন যশোরের আপন নীড়ে। এখন ওই তরুণীর মানসিক সুস্থতা ফেরানো পরিবারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসক ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মেয়েটি ট্রমার মধ্যে আছেন। স্বাভাবিক হতে আরও কিছু দিন লাগতে পারে।

এ ধর্ষণের ঘটনায় গত শনিবার রাতে রাজধানীর গাবতলী, ডেমরা, বছিলা ও ভোলার তজুমুদ্দিন থেকে অভিযুক্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

তরুণীর মা গতকাল রোববার কাছে মেয়ের জীবনের করুণ কাহিনি তুলে ধরতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, বছর দশেক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক মাদ্রাসাশিক্ষকের সঙ্গে পারিবারিকভাবে তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। প্রথম দিকে ছিল সুখের সংসার। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। সর্বশেষ ছিলেন মোহাম্মদপুরের বছিলায়। তরুণীর মা জানান, বছরখানেক আগে হঠাৎ একদিন ঢাকা থেকে যশোরে মেয়েকে নিয়ে আসেন জামাই। সকালে বাসায় পৌঁছার পর জামাই বলছিলেন, তাঁর স্ত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কয়েক দিন গ্রামের বাড়িতে রাখলে ভালো হয়ে যাবেন। এরপর আবার ঢাকায় ফিরিয়ে নেবেন। গ্রামের বাড়িতে অল্প সময় অবস্থানের পর জামাই বলছিলেন, খুলনায় তাঁর একটি কাজ আছে। সেখানে যাওয়া জরুরি। খুলনার কাজ সেরে আবার যশোর শ্বশুরবাড়িতে ফিরবেন। তবে আর ফেরেননি মেয়ের জামাই। মোবাইল ফোনও বন্ধ করে দেন। তবে অনেক দিন পরপর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ৯ বছরের ছেলে ও ৬ বছরের মেয়ের ছবি যশোরে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতেন। সন্তানদের ওই ছবি দেখে আরও ব্যাকুল হয়ে উঠত মেয়ে।

তরুণীর মা আরও জানান, এক বছর ধরে ওই তরুণী বাবার বাড়িতে থাকছিলেন। মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে সন্তানদের নাম বলে চিৎকার দিতেন। প্রায়ই বলতেন, সন্তানদের খোঁজে ঢাকায় যাবেন। মাস চারেক আগে হঠাৎ ঢাকা থেকে তালাকের কাগজপত্র গ্রামে পৌঁছে। এরপর আরও ভেঙে পড়েন তরুণী। এর মধ্যেই তাঁর জীবনে ঘটে আরেক ঘটনা। মাস তিনেক আগে স্থানীয় কলেজের এক কর্মচারী তরুণীকে জোর করে বিয়ে করেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পরিবারও সেই বিয়েতে মত দেয়। তবে বিয়ের এক মাসের মাথায় দ্বিতীয় স্বামীও তাঁর মেয়ের কোনো খোঁজখবর নিতেন না। সব মিলিয়ে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে কাটছিল তরুণীর দিনলিপি। বুধবার বাসার কাউকে না জানিয়ে ৭ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোনসেট সঙ্গে নিয়ে দুই শিশুসন্তান ও প্রথম স্বামীর খোঁজে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। ওই রাতে পুলিশের মাধ্যমে স্বজনরা দুর্বিষহ ঘটনা জানতে পারেন।

ওই তরুণী ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বুধবার যশোর থেকে ঢাকায় পৌঁছে বছিলায় সেই পুরোনো ঠিকানায় যান তরুণী। তবে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে খবর পান- অনেক আগেই তাঁর প্রথম পক্ষের স্বামী দুই সন্তানকে নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর আশপাশ এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে সন্তানদের খুঁজতে থাকেন। দিনভর খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যান। ওই সময় এক পথচারী ‘মিম’ হোটেলে নিয়ে তাঁকে খাওয়ান। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে যশোরে ফিরে যেতে মনস্থির করেন। বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বছিলার তিন রাস্তার মোড় থেকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার উদ্দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাড়া করেন। চালক তাঁর সঙ্গে নানা ধরনের আলাপ করতে থাকেন। প্রথম পক্ষের স্বামীর নাম ও ঢাকায় আসার কারণ জানালে চালক বলেন, অনেক দিন তিনি বছিলায় বাস করছেন। ওই নারীর স্বামীকে তিনি চেনেন। তাঁর বাসা খুঁজে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর প্রায় তিন ঘণ্টার মতো বছিলা ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় তাঁকে রিকশায় ঘোরাতে থাকেন। ঘোরার সময় রিকশাচালক মোবাইল ফোনে অনেকের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বছিলার ফিউচার টাউন রোডের শেষ মাথায় একটি নির্মাণাধীন বাড়ির ভেতরে তাঁকে নেওয়া হয়। শ্রমিকদের জন্য সেখানে অস্থায়ীভাবে একটি টিনের ঘর তৈরি করা ছিল। জনশূন্য ওই বাড়িতে নেওয়ার পর মেয়েটিকে চুপ থাকতে বলা হয়। তাঁদের কথায় রাজি না হলে তাঁরা হত্যার হুমকি দেন। ভয় দেখাতে একজন তরুণীকে চড়ও মারেন। এরপর তাঁর ওপর বর্বর আচরণ করেন। রিকশাচালক ছাড়াও সাতজন সেখানে ছিলেন। অন্যদের ওই চালক খবর দিয়ে আগে থেকে জড়ো করেন। তরুণীর সঙ্গে পাঁচ পাষণ্ড খারাপ আচরণ করার পর হঠাৎ ওই এলাকার এক নিরাপত্তারক্ষীর বিষয়টি চোখে পড়ে। তিনি চিৎকার শুরু করলে তরুণীকে ফেলে সাতজনই পালিয়ে যান। এরপর মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে খবর দিলে ওই নারীকে উদ্ধার করে হেফাজতে নেয়। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠানো হয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় দলবদ্ধ ধর্ষণের আলামত মিলেছে। মোহাম্মদপুর থানার এ ঘটনায় মামলা হয়।

তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার এইচ এম আজিমুল হক জানান, ধর্ষণের ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার রাতে ভোলা, ঢাকার গাবতলী ও ডেমরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের। তাঁরা হলেন- বিল্লাল হোসেন (২৫), শফিকুল ইসলাম (২৬), আল আমিন হোসেন (২৬), রাসেল ওরফে মোল্লা রাসেল (২৪) ও সবুজ (২৬)। এই ঘটনায় জড়িত আরও দু’জনকে খোঁজা হচ্ছে। তাঁদের গতকাল আদালতে হাজির করলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন আল আমিন হোসেন, সবুজ ও শফিকুল। এরপর তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, আসামিদের শনাক্ত করতে বছিলার ৪০ ফিট, ফিউচার হাউজিং, গার্ডেন সিটি হাউজিং, স্বপ্নধারা হাউজিং ও আশপাশের প্রায় আড়াইশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্নেষণ করা হয়েছে। মেয়েটির সর্বনাশের জন্য মূল দায়ী অটোরিকশাচালক শফিকুল। ঘটনার দু’দিন পর রিকশা বিক্রি করে স্ত্রী-সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি ভোলার তজুমুদ্দিনে চলে যান তিনি। প্রযুক্তিগত তদন্তের পর সেখান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন