প্রকৃতি কন্যা শিউলী

অথর
কুষ্টিয়া অনুসন্ধান নিউজ ডেক্স :   বাংলাদেশ
প্রকাশিত :১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১:৩৪ পূর্বাহ্ণ | নিউজটি পড়া হয়েছে : 333 বার
প্রকৃতি কন্যা শিউলী

একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতে বেশি পছন্দ করত। ইচ্ছে আর পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী যার যতটুকু সম্ভব পড়াশোনা করেছে। তারপর বিয়ে, ঘর-সংসার। অনেক উচ্চশিক্ষিত মেয়েদেরও কাজের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। হাতের কাজ যে যা জানত তা দিয়ে ঘর সাজাত, প্রিয়জনদের উপহার দিত। সময় বদলেছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিন্তা-ভাবনায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। মেয়েরা এখন আর শুধু ঘরে বসে থেকেই জীবন পার করতে নারাজ।

এখন সবাই আত্মনির্ভরশীল হতে চায়। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক হোক আর নিজে উদ্যোক্তা হয়েই হোক। যাদের চাকরি করার ইচ্ছে কম, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বেশি পছন্দ, তারাও এখন ঘরে বসে উপার্জনের চেষ্টা করছেন নিজেকে স্বাবলম্বী করার জন্য। অনেকেই নিজের হাত খরচের পাশাপাশি সংসারেও সহযোগিতা করছেন।
মাদারীপুর শিবচরের মেয়ে নাছরিন আক্তার শিউলী। বাবা চাকরি করতেন প্রকৃতির লীলাভূমি ডিসি অফিস বান্দরবানে। সেই সুবাদে সেখানেই জন্ম এবং বেড়ে উঠা। বাবার বদলির পর ফিরে গিয়েছিলেন মাদারীপুরে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ¯œাতক এবং ইসলামিক আর্ট অ্যান্ড আর্কিটেকচার নিয়ে ¯œাতকোত্তর করেন। আঁকার প্রতি ঝোঁক তার সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল। মেঝো ভাই সুন্দর আঁকতেন, তার কাছেই শিউলীর হাতেখড়ি।

৭ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় পেয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। ভাইয়েরা সবাই চাকরি করছেন। আর বোনেরা গৃহিণী। শিউলী পড়াশোনায় ভালো বিধায় সবার চাওয়া সে ভালো কোনো চাকরি করবে। তাই চারুকলায় পড়ার ইচ্ছে থাকলেও কেউ সমর্থন করেনি। তবে ইসলামিক আর্ট অ্যান্ড আর্কিটেকচারে পড়ার সময় আঁকার প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। আর প্রকৃতি তো গেঁথেই ছিল শিউলীর হৃদমাঝারে। মাস্টার্সের পর হুট করেই মাথায় এলো বাণিজ্যিকভাবে আঁকার কথা।
শিউলী বলেন, ‘আমি এই কাজে সম্পৃক্ত হয়েছি মাত্র ৪ মাস হলো। প্রথম মাসেই সাড়া পেয়েছি প্রচুর। সবাই আমার পেইন্টিংস, মিরর বেশ পছন্দ করছে। আর বাধা কিংবা উৎসাহ বলতে কেউ খুশি, কেউ চিন্তিত- হয়ত আমার চাকরি করার ইচ্ছে নেই এই ভেবে। আমার স্বামী আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ এবং সহযোগিতা করেন। যদিও এই উদ্যোগ নেওয়ার আগে আমি যথেষ্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলাম। কারণ আমি একজন আমলার বউ।

আমলার বউ হয়ে এটা করা কতটা সম্মানজনক কিংবা আমার স্বামীর কোনো কারণে সম্মানহানি হয় কিনা এসব ভেবে। এই নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার উদ্যোগ আমার চাকরি থেকেও অনেক বেশি সম্মানজনক।’ আমার জন্মস্থান বান্দরবান এবং কাকতালীয়ভাবে আমার স্বামীর কর্মস্থলও এখানে। বান্দরবানে সহকারী কমিশনার পদে আছেন তিনি। এত বছর পর মায়ের মতো আমিও নিজের সংসার পেতেছি এখানে, মা যেভাবে পেতেছিলেন। বিসিএস দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কাজের নেশায় পড়ার বেশ ক্ষতিই হচ্ছে। এমনকি এখন আমি দ্বিধায় আছি চাকরি করব, নাকি আমার এই স্বপ্নটাকে নিয়েই এগিয়ে যাব! পেইন্টিং বা আর্ট মানুষ যত সহজভাবে দেখে অত সহজ না।

দাম শুনে আঁতকে ওঠে। কিন্তু এসবের জন্য আমাকে অনেক ছাড়ও দিতে হচ্ছে। একটা মিরর নিয়ে আমি যখন বসি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়। কোমর-ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। আর পেইন্টিংয়ের প্রোডাক্টেরও অনেক দাম। সব হিসাব করলে দাম বেড়ে যায়। আসলে আমার মনে হয় একজন শিল্পীকে কখনোই মূল্য দেওয়া যায় না। আমরা শাড়ি/জামা যেভাবে কেনা-বেচা করি সেভাবে আর্ট কেনা-বেচা যায় না। তাহলে ‘মোনালিসা’র দাম এত হতো না।

কিংবা দেখতে অনেক তুচ্ছ পেইন্টিংও মানুষ এত দাম দিয়ে কিনত না।’ শিউলী কাজ করছেন মান্ডালা মিরর, ক্যানভাস এক্রিলিক-সিলিকন-টেক্সচার পেইন্টিং এবং স্কেচ নিয়ে। একজন নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে এক মাসের মাথায় মোটামুটি ২০ হাজার টাকার বেশি পেইন্টিং, স্কেচ বিক্রি হয়েছে তার।

আমি নিজে এ পর্যন্ত যতজন উদ্যোক্তা অঙ্কনশিল্পী দেখেছি, তাদের মধ্যে শিউলীর আঁকাগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ আলাদা লেগেছে। এতদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি বিদেশী চিত্রশিল্পীরা দেওয়ালে রং ছুড়ে তা দিয়ে খুব সুন্দর সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি করছেন। আমাদের দেশেও এমন অনেক শিল্পী আছেন। কিন্তু শিউলীর বিষয়টা আলাদা লেগেছে কারণ তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই।

কাগজের উপর চা ফেলে, হলুদ গুলানো পানি ফেলে সেখান থেকে তৈরি করছেন ব্যতিক্রমি সব শিল্পকর্ম। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিউলী জানান,‘ফেসবুকে বিদেশীদের কফি, ওয়াইন দিয়ে এমন ছবি আঁকতে দেখেছিলাম। আমি তার বদলে দুধ চা আর হলুদের গুঁড়া ব্যবহার করেছি। আমি আসলে কখনোই নিজেকে আর্টিস্ট বলতে চাই না। আমার কাছে মনে হয় আমি এখনো কিছুই জানি না। যতটা জানলে একজন মানুষকে আর্টিস্ট বলা যায়।’ শিউলী ভবিষ্যতে কোন পথে হাঁটবে জানি না।

তবে পথ যেটাই হোক, সঙ্গী থাকুক তার এই প্রতিভা। বেঁচে থাকুক তার নিজের স্বপ্ন ‘দ্বি রঙ’। তার সৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ুক সব জায়গায়। শিউলীর মতো সৃষ্টিশীল মেয়েরা এগিয়ে আসুক তাদের নিজস্ব সুপ্ত প্রতিভা নিয়ে।

সংবাদটি শেয়ার করুন